
আমাদের প্রিয় লেখক শঙ্কর আনন্দবাজারের প্রতিনিধি হিসাবে একদা সত্যজিৎ রায়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন, পথের পাঁচালি মুক্তির (১৯৫৫) ৩০ বছর পর। আমরা সবাই জানি “পথের পাঁচালি” সত্যজিৎ রায়ের প্রথম প্রছেষ্টা। সত্যজিৎ রায় তখন “সত্যজিৎ রায়” হননি, তাই তখন তাঁর “পথের পাঁচালি” নিয়ে অনেক কথা, অনেক সমালোচনা তখন হয়েছিল। অনেক ঘটনা, সমালোচনা হয়েছিল আমরা তা জানি না। লেখক শঙ্কর তাঁর “চরন ছুঁয়ে যাই” বইতে কিছু কিছু লিপিবদ্ধ করেছেন, যা মনে দাগ কেটে যায়।
“ছবিটা তৈরী করতে দু-আড়াই লাখ টাকা লেগেছিল। একসময় রানা অ্যান্ড দত্ত থেকে হাজার কুড়ি টাকা হুন্ডিতেও নিতে হয়েছিল। ধার চেয়েও অনেকসময় পাওয়া যায়নি। যে ভাঙ্গা বাড়ীটায় বেশিরভাগ শ্যুটিং হয়েছিল তা মাসিক পঞ্চাস টাকায় ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। শ্যুটিং হোক না হোক আড়াই বছর ধরে ওই মাসিক ভাড়া গুনতে হয়েছিল। চিত্রসত্বের জন্য বিভুতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবার বোধহয় পেয়েছিলেন হাজার দশেক।”
“প্রডিউসারদের দ্বারস্থ না হয়ে, আমাদের নিজেদের যে সঙ্গতি আছে তাই দিয়েই কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত হলো। ইতিমধ্যেই অপু এবং দুর্গাকে পাওয়া গিয়েছে। আমরা ১৯৫৩ সালের অক্টোবর মাসে জগদ্ধাত্রী পুজোর দিনে এক কাশবনে সুটিং আরম্ভ করলাম। লোকেশন শক্তিগড়ের আগে পালশিট ষ্টেশনের কাছে।… “
সত্যজিৎ রায় “…… এবার ভাবলাম কোনো প্রডিউসারকে আগ্রহী করা যায় কিনা। ধর্মতলায় প্রডিউসারদের দরজায় দরজায় ঘুরেছি, কত লোককে বার বার শুনিয়েছি, জুতোর গোড়ালি ক্ষয়ে গিয়েছে, কিন্তু কাউকে রাজি করাতে পারিনি। তখন রাগ হতো, এখন দোষ দিই না এঁদের। আমাদের কারও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। প্রডিউসারদের নিশ্চয় সন্দেহ হতো ওঁরা কি পারবেন?”
“টাকার অভাবে দীর্ঘ সময় যখন কাজ বন্ধ তখনকারযন্ত্রনার ইতিবৃত্ত নানা পত্র পত্রিকায় ছড়িয়ে রয়েছে। হটাৎ কে যেন বললো একবার ডঃ বিধান রায়কে ধরে দেখলে হয় না?” “বিধানবাবু আমাদের ছবি দেখলেন, খুশি হলেন এবং ছবির দায়িত্ব গ্রহন করলেন। যা নিজেদের পকেট থেকে এবং ধার করে খরচ হয়েছিল তা মিটিয়ে দিলেন এবং বাকি টাকা দেবার নির্দেশ দিলেন।”
“ছবি করতে গিয়ে মানুষ হিসেবেও আমার অনেক অভিজ্ঞতা হলো। শহরে জন্মেছি, গ্রাম এবং প্রকৃতি সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ কোনো ধারনাই ছিল না। ….. বিভুতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইথেকে গ্রামকে জেনেছি, কিন্তু শুটিং করতে গিয়ে গ্রামকেভালবেসেছি, সেখানেই যে আমার শিকড় রয়েছে তা বুঝেছি।ছবিটা করতে গিয়ে শুধু ছবি তোলার অভিজ্ঞতা হয়েছে তা নয়, তাঁর বাইরেও প্রচুর অভিজ্ঞতা যা আমাকে মানুষ হিসাবে পরিণত করেছে , আমাকে দেশকে ভালবাসতে শিখিয়েছে।
সমস্ত কাজের জন্য পথের পাঁচালি থেকে সত্যজিৎ রায় আট / দশ হাজারের বেশী পাননি।সত্যজিত রায় কিন্তু ওইসব চিন্তায় মোটেই বিব্রত নন। তিনি বললেন, “কোন দুঃখ নেই। নিজের পায়ে দাঁড়াবার সুযোগটা ওখান থেকেই পেয়েছি, সেটার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। ছবিটা শেষ না হলে আমাকে বিজ্ঞাপন অফিসের দাসত্ব করতে হতো। আমি যে ফিল্মমেকার হতে পেরেছি এর জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারই দায়ী।”
পথের পাঁচালির সমালোচনার অনুরোধে গভীর চিন্তায় ডুব দিলেন সত্যজিৎ রায় । বললেন, “ছবিটা তুলেছিলাম এমনভাবে যাতে কঠিন দৃশ্যগুলো গল্পের শেষের দিকে আসে। গল্পটা গোড়া থেকে আরম্ভ করে যেরকম বিন্যস্ত সেইভাবে তুলেছিলাম। ফলে ছবিটায় শেষের দিকের কাজ প্রথম দিকের থেকে অনেক পাকা। প্রথম দিকে অনভিজ্ঞতার অনেক ছাপ রয়ে গিয়েছে। পথের পাঁচালিকে নতুন করে এডিট করতে পারলে আমি খুব খুশি হতাম।নতুন করে কাঁচি চালাতে পারলে প্রথম দিকের কিছু কিছু দীর্ঘ দৃশ্য ছোট হত। জিনিষটা আরও পরিপাটি ও ছিমছাম হতো, গতি বাড়তো। গোড়ার দিকের কিছু দৃশ্য বড্ড কাঁচা লাগে।”
সংবাদপত্রের প্রতিনিধি হিসাবে আমার ( লেখক শঙ্কর বলছেন ) কিছু অপ্রিয় দায়িত্ব থেকে যায়। তাই জিজ্ঞেস করলাম ” কবে আপনি বুঝতে পারলেন যে পথের পাঁচালি বিশ্বজয়ী হতে চলেছে ?”
শঙ্কর লিখছেন । সত্যজিৎ আবার চিন্তাসাগরে ডুব দিলেন।”আমেরিকায় রিলিজ ডে তে হলের লবিতে বসে আছি। রাত তখন বোধহয় আটটা সাড়ে আটটা । হল থেকে সাদা এবং কালো মানুষ বেরিয়ে আসছেন। তাদের সকলের চোখে জল। কেও কেও আমার দিকে এগিয়ে এলেন, বললেন, কোনো ছবি এমনভাবে বুকে লাগেনি।”
আবার চিন্তা করলেন সত্যজিৎ রায়। “তবে মনে রাখবেন বিদেশ জয় করবার পর পথের পাঁচালি স্বদেশে স্বীকৃতিলাভ করেছে, এই অভিযোগ নিছকই গুজব মাত্র। প্রথম দিন থেকে দেশের মানুষ আমাকে যা প্রাপ্য তাঁর চেয়ে বিন্দুমাত্র কম দেননি।”
“গুজবের কথা যখন তুললেন, কেও কেও বলেন, ছবি শেষ হবার আগেই নেহরু পরিবার আপনাকে সাহায্য করেছিলেন।”
“আগে কিছু সাহায্য পাইনি।তবে বিদেশ মন্ত্রকের কিছু আমলা যখন ভারতবর্ষের দারিদ্রকে অতিমাত্রায় প্রচারিত করা হয়েছে এই অভিযোগে বিদেশে পথের পাঁচালি প্রদর্শনে বাগড়া দিচ্ছিলেন সেই সময় জওহরলাল ছবিটা দেখেছিলেন। সেই শোতে ডঃ বিধানচন্দ্র রায় এবং বিজয়লক্ষী তনয়া নয়নতারা উপস্থিত ছিলেন। ছবির শেষে জওহরলাল কাঁদতে লাগলেন এবং অবশ্যই বিদেশে প্রচারের সব বাধাবিপত্তি সরিয়ে নিলেন।”
“আরেকটি গুজবঃ আনন্দবাজারে নাকি প্রথমে নিন্দা এবং পরে প্রশংসা প্রকাশিত হয়েছিল?”
“ঠিক কথা নয়। বসুশ্রী-বীণাতে মুক্তির পরের সপ্তাহেই আনন্দবাজারে লেখা হয়েছিলঃ “বিশ্বের একখানি সেরা ছবি তোলার কৃতিত্ব দেখাবার মতো প্রতিভাও যে এদেশে আছে পথের পাঁচালি দেখার আগে তা নেহাতই স্বপ্নকথা ছিল।” নিউইয়র্ক টাইমসের জাঁদরেল সমালোচক ক্রাউযার কিন্তু প্রথমে তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। পরে প্রতিবাদে বহু চিঠি প্রকাশিত হতে লাগলো নিউইয়র্ক টাইমসে। তখন ক্রাউযার তাঁর মত পাল্টে আর একটি প্রশংসাসূচক সমালোচনা লেখেন।”
পুরনো গ্লানি তিরিশ বছরের দূরত্ব পেরিয়ে সত্যজিৎ রায় পুনরাবিষ্কার করতে চাইলেন না। অনেক অনুরোধের পর জানালেন, “সবচেয়ে খারাপ মন্তব্য হয়েছিল কলকাতায়। এক বিখ্যাত এবং বহুপুরস্কৃত সাহিত্যিক জানিয়েছিলেন, ছবিটি দেখে বোঝা গেল সত্যজিৎ রায় সাহিত্যের কিছুই bঝেন না।”
সবচেয়ে স্মরনীয় সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিল আমেরিকার ফিল্ড কোয়ার্টালিতে – আর্লিন ক্রোচে নামক এক মহিলা “দারুন রিভিউ করেছিলেন। ভদ্রমহিলা ছবির অন্তস্তলে প্রবেশ করেছিলেন, কী করে পেরেছিলেন তা আমি নিজেও জানি না।” বললেন সত্যজিৎ রায়।

xxxxxx

Karuna Banerjee as Sarbojaya & Chunibala Devi as Indir Thakrun (Old Aunt)
ABOUT THE NOVEL :
পথের পাঁচালী (Pother Panchali), translated as Song of the Road is a novel written by Bibhuti Bhushan Bandopadhyay and was later adapted into a film of the same name by Satyajit Ray. Pather Panchali deals with the life of the Roy family (Harihar Roy, the protagonist of the story), both in their ancestral village in rural Bengal and later when they move to Varanasi in search of a better life, as well as the anguish and loss they face during their travels. The novel was originally published in 1929, this was the first published novel by the author.
Subir Banerjee as Apu and Runki Banerjee as Durga (Child) & Uma Dasgupta as Durga (Teenager) |
Like this:
Like Loading...