মানুষ

সাদাত হোসাইন

তখন ‘পানি’কে ‘জল’ বললেই পিঠের উপর দুমদাম পড়তো।

এটা আম্মার ইসলামি আদব লেহাজ শেখানোর অংশ ছিল। সাথে ছিল বাজখাঁই গলায় বকুনি, ‘মোসলমানের পোলা হইয়া পানিরে কস্ জল, ছি ছি ছি। এই হাতের গেলাসের পানি ফেলা। এই পানি এহন আর হালাল নাই, ফেলা, ফেলা। বিসমিল্লাহ বইলা আবার পানি নে। তারপর মাটিতে বইসা আদবের সাথে তিন ঢোক দিয়া খা, তিন ঢোকে সব পানি খাবি। এক ঢোকে না। এক ঢোকে পানি খায় শয়তানে’।

আমি গ্লাসের পানি ফেলে দিয়ে আবার পানি নিয়ে মাটিতে বসে আদবের সাথে গ্লাসে চুমুক দিতে যাবো, অমনি আম্মার জোর চিৎকার, ‘পানি খাওনের দোয়া পরছস? জানোস দোয়া? দোয়া পড়, দোয়া পড়’।

– ‘দোয়াতো ভুইলা গেছি আম্মা!’

– ‘কি! দোয়া ভুইলা গেছস!! কই নিবি আমারে? কই? দোজখে? অক্ষন দোয়া মুখস্ত কর, অক্ষন, বল, অসাকা হুম রব্বাহুম সরাবান তহুরা’। পড়, মুখস্ত কর, মুখস্ত কইরা তারপর এইখান থেইকা উঠবি’।

আমি গভীর মনোযোগ এবং খানিক আগে দোয়া ভুলে যাওয়ার ভয় নিয়ে দোয়া মুখস্ত করতে বসে গেলাম। অসাকা হুম রব্বা হুম সরাবন তহুরা।

এই দৃশ্য কেবল আমার একার না। কমবেশি সেই সময়ের আমাদের সবারই। আমরা তখন ভুলেও পানিকে জল বলি না। বরং বিলের পানিতে ফুটফুটে শাপলা ফুলের মধ্যেও তখন হিন্দু শাপলা আর মুসলমান শাপলা খুঁজি! চিকন চাকন দেখতে কট কটা লাল রঙের শাপলাগুলো হোল হিন্দু শাপলা। আর ধবধবে সাদা রঙের মোটা তাজা শাপলাগুলো মুসলমান শাপলা। আমরা বেছে বেছে সাদা শাপলাগুলো তুলে আনি। সেকালে গ্রামের মানুষদের বিনা পয়সায় পেটে জামিন দেয়ার নানান রকম ফন্দি ফিকির খুঁজতে হতো। সেক্ষেত্রে তরকারি হিসেবে শাপলা ছিল অপ্রতিদ্বন্ধি। চিংড়ির সাথে শাপলার ঝোল কিংবা ভাজির স্বাদ এখনো চোখ বুজলেই জিভের ডগায় লেপটে থেকে চাগিয়ে ওঠে! আহা!

কে শিখিয়েছে, কিংবা কিভাবে শিখিয়েছে জানি না। তবে এই হিন্দু মুসলমান বিভাজন খুঁজতাম সবকিছুতেই। হিন্দুদের আমরা বলতাম ‘নোমো’। এই নোমোদের সবকিছুই খারাপ। আমাদের কাছে ‘নোমো’ মানেই খারাপ। যেন একটা গালি! এরা পরিত্যাজ্য। কেবল চুল কাটাতে বিপুল নাপিত ‘নোমো’ হলেও তার কাছে যাওয়া যাবে, আর দা কুড়াল ধার দিতে শিতেশ কম্মকার! আমরা বাচ্চারাও এই বিভাজন সবক্ষেত্রেই মেনে চলতাম। কঠোরভাবে মেনে চলতাম। এমনকি আর সব পিঁপড়ার মধ্যে থেকেও ছোট ছোট লাল পিঁপড়েগুলোকে বেছে বেছে আঙুলের ডগায় পিষে দিতাম। যা বাবা! একটা ‘নোমো’ পিঁপড়াতো গেল!

‘নোমো’দের সব জিনিসকে খারাপ ভেবে তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চললেও চৈত্র মাস এলেই কেমন গাঁইগুঁই করা শুরু করতাম। আম্মার কাছে গিয়া বলতাম, ‘আপনে যে কন হিন্দুদের সব কিছুই খারাপ, এই কথা কিন্তু সত্য না’।

– ‘কিভাবে সত্য না?’

– ‘এই যে দেখেন আদর্শলিপি নামে যে বই আছে, সেই বই ভর্তি ভালো ভালো লেখা, এই বই কে লিখছে? লিখছে, সীতানাথ বসাক। সে কি হিন্দু? না মুসলমান? সে কিন্তু হিন্দু। দেখছেন কি ভালো ভালো কথা লেখছে!’

আম্মা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ কটমট করে বললেন, ‘আসল উদ্দেশ্য কি সেইটা বল’।

আমি উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেখানে বিশাল শিমুল গাছের মাথায় লাল শিমুল ফুলগুলো পরিণত হয়ে বড় বড় ফল হয়েছে। সেই শিমুল ফলের ভিতরেই শিমুল তুলা। বাজারে সেই শিমুল তুলার দাম মাশাল্লাহ ভালো। আমি কিছু তুলা এর মধ্যেই বিভিন্ন গাছ থেকে চুরি টুরি করে জমিয়ে রেখেছি। আরও কিছু তুলা জমাতে পারলেই কেল্লা ফতে। সময় আর বেশি বাকি নাই। আরতো মাত্র ক’টা দিন। তারপরেই…!

আম্মা আবার জিজ্ঞাস করেন, ‘কিরে, মতলব কি?’

আমি উদাস গলায় জবাব দেই, ‘মতলব কিছু না’।

আম্মা হঠাৎ কড়ে আঙুলে মাস গোনেন আশ্বিন, কার্তিক… চৈত্র… বৈশাখ…! হ্যা, বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের মাস!

তারপর হঠাৎ শক্ত হাতে আমার কান চেপে ধরেন, ‘ওরে আল্লাহ! তুই এইবারও গোলোইয়ায় যাবি! গোলোইয়ায় যাবি! তোর সাহসতো কম না’! আমি নির্বিকারভাবে বলি, ‘সবাইতো যায় আম্মা, আমি গেলে কি হইছে?’

আম্মা বলেন, ‘গুনা হইব বাজান, এই সব মেলা ফেলায় যাওন ভালো না। ওইখানে পূজা হইব, নাচ গান হইব, ওইখানে যায় না বাজান’।

কিন্তু আম্মা জানেন, তিনি ‘গোলোইয়ায়’ যাওয়া থেকে আমাকে ফেরাতে পারবেন না। আমি যাবোই। আমাদের অঞ্চলে তখন বাংলা নববর্ষে বিশাল বৈশাখী মেলা হতো। গৌরনদী অঞ্চলের এই বিশাল মেলাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হতো গোলোইয়া। এই গোলোইয়া নিয়ে তখন আশেপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে সে কি উন্মাদনা! উত্তেজনা! কৌতূহল! সেই মেলায় যাত্রাপালা হয়, পালাগান হয়, পূজা হয়! কি সুন্দর সব প্রতিমা! কিন্তু হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার সেই মেলা তখন যেন আর আমার মতো মুসলমান পরিবারের কাছে বাঙ্গালী সংস্কৃতি নয়, যেন শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতির উপলক্ষ্য। আমাদের তাই সেখানে যাওয়া বারণ! আমি ঘরের কোণায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদি! আর জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি, ইশ! কত মানুষ রঙবেরঙের জামা পড়ে গোলোইয়ায় যাচ্ছে! কতো কতো মানুষ গোলোইয়া থেকে ফিরছে! ইশ! তাদের হাত ভর্তি কত কত খেলনা! কতো কতো জিলিপি, সন্দেশ, মুড়িমুড়কি, নাড়ু, বাতাসা! ইশ!!

রঙের পসরা মেলে বসা সেই মেলা যেন বর্ণীল জীবনের সবটুকু রঙ। আমার মতো কিশোরের কাছে সেই রঙ তখন স্বপ্নের দেশ! রূপকথার জগত! সেখানে হিন্দু-মুসলমান, পাপ-পুণ্য কিংবা ন্যায়- অন্যায়ের বোধ তখন নিতান্তই গৌণ। আমরা উন্মুখ হয়ে থাকি গোলোইয়া শুরুর মাস তিনেক আগে থেকেই। কি কি কিনবো মনে মনে তার তালিকা করি। উশখুশ করি। নানান ফন্দি ফিকির করি, প্ল্যান-পরিকল্পনা করি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে টাকা কই পাবো? টাকা? আম্মাতো যেতেই দিবেন না। টাকা দেয়াতো অনেক দূরের কথা! যেতে হলেও যেতে হবে আম্মাকে না বলে। পালিয়ে। কিন্তু টাকা কোথায় পাবো?

টাকার ব্যাবস্থাও অবশ্য আমাদের আছে। আমরা গাছে গাছে পেকে যাওয়া শিমুল তুলো চুরি করে শিমুল তুলো জমাই। লুকিয়ে লুকিয়ে রোদে শুকাতে দেই। ভেজা তুলা কেউ কেনে না। প্রতিদিন আম্মার চোখ লুকিয়ে সেই তুলা রোদে শুকাই, আবার নিজের গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখি। দিনে দিনে একটু একটু করে ওজন বাড়ে। আজ-কাল-পরশু। প্রতিদিন ওজন মেপে দেখি! ইশ! যদি এক কেজী হতো! তাহলে কত দাম পাবো? তিরিশ টাকা? নাকি চল্লিশ? ভাগ্য ভালো হলে পঞ্চাশও পেয়ে যেতে পারি!
পঞ্চাশ টাকায় কি কি পাওয়া যায়?

আমি সেবার এক কেজির মতো তুলার ব্যাবস্থা করে ফেললাম!সত্যি সত্যি এক কেজী! রাতে আমার ঘুম হয় না! ছটফট লাগে! দমবন্ধ লাগে উত্তেজনায়, আনন্দে! টেনশনে! ইশ! এক কেজী! কি কি কিনবো? লাল নীল চরকী, লম্বা বাঁশি, চশমা, বাতাসা… আমার আর সময় কাটে না। রাত ভোর হয় না, ভোর হলে দুপুর হয় না। সন্ধ্যা হলে রাত হয় না। গোলোইয়ার দিন আর আসে না, আসে না।

গোলোইয়ার দিন দুপুরে শুকনো ক্ষেতের আইল ধরে হাটা দেই। নদী পেড়িয়ে গৌরনদী হেঁটে যেতে যেতে ঘণ্টাখানেক লাগবে। আমি জোর কদমে হাটি। গা বেয়ে ঘামের স্রোত নামে। কিন্তু বুকের ভেতর উচ্ছ্বাস! আরতো কিছুক্ষন! তারপরই সেই গোলোইয়া! সেই মেলা! আমি মাথা নিচু করে হাতের তুলার বস্তাটা দেখি! বুকের ভেতর প্রজাপতিরা ডানা ঝাপটায়। নানান রঙের প্রজাপতি। লাল, নীল, হলুদ! ওরা বুকের ভেতর রঙ ছড়িয়ে পাখা ঝাপটায়।

আজ রঙের দিন!

খেয়া নৌকায় নদী পার হবো। নৌকা ভর্তি গিজগিজে মানুষ। আমি কোন মতে গুটিসুটি মেরে নৌকার পাটাতনে উঠে পড়ি। তুলোর বস্তাটা বুকের সাথে চেপে ধরি। গোলোইয়ায় যাওয়া মানুষের ভিড়ে নৌকাটা টইটুম্বুর। তিল ঠাঁই আর নাহিরে অবস্থা। নৌকাটা হঠাৎ বাঁ পাশে কাত হয়ে পড়ে। কাত হয়ে পড়ে। আমি প্রাণপণে পাটাতনের কাঠ আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না। টুপ করে পড়ে যাই জলের ভেতর। আমি এক না। আরও অনেকেই। কিন্তু তাদের আমি দেখি না। সেই বুক সমান জলে দাঁড়িয়ে আমি সেই তুলার বস্তাটা জলের ভেতর থেকে টেনে বের করি! অতো হালকা বস্তাটা জলের ভেতর এতো ভারী হয়ে আছে যে আমি আর টেনে তুলতে পারি না! আমার চোখের ভেতর জ্বালা করে ওঠে। টুপটুপ করে ক’ফোটা চোখের জল সেই নদীর পানিতে মিশে যায়।

কি অদ্ভুত! কান্নার জল নদীর জল থেকে আলাদা করা যায় না।

পরিশিষ্টঃ ——————-

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে।

সেই ভেজা তুলার বস্তা নিয়ে আমি বসে আছি সেই নদীর পাশেই ক্ষেতের মাঝে এক বাঁশবাগানের ভেতর। বাশবাগানের পাশের হিন্দু বাড়িটা থেকে উলুধ্বনির শব্দ আসছে! আমার ভয় লাগছে। চোখের কোলে শুকিয়ে যাওয়া জলের দাগ। তবুও আমি সেই অন্ধকারে বসে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদি আর কাঁদি! অন্ধকার আরও গভীর হয়, আমি কাঁদতেই থাকি! কাঁদতেই থাকি। হঠাৎ সেই অন্ধকারের ভেতর থেকে কেরোসিনের কুপি হাতে কেউ একজন এগিয়ে আসেন। তার সিঁথিতে সিঁদুর। এক ‘নোমো’ মহিলা। তিনি এসে পরম মমতায় আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কি হইছে তোমার? কান্দ ক্যান?’

আমি জবাব দেই না। কাঁদতেই থাকি। তিনি তার কুপির আলোয় আমার পাশে পড়ে থাকা ভিজে চুপচুপে হয়ে যাওয়া তুলোর বস্তাটা দেখেন। তাকে আমি কিছু বলি না। কিন্তু তিনি যেন সব বুঝে যান। তিনি চুপচাপ আমার পাশে এসে বসেন, ‘তোমাগো বাড়ি কই বাপ? কইত্থেইকা আইছ? মেলায় আইছিলা? বাড়িতে বইলা আসো নাই? খাইছ কিছু? আসো আমার লগে আসো, বাড়ির ভিতর আসো’।

আমি তার কোন প্রশ্নের জবাব দেই না। কিন্তু তার পিছু পিছু বাড়ির ভেতর যাই। আমার কেন যেন ভয় করে না। এতো দিন লালন করে আসা ‘নোমো’ দের প্রতি কোন বিতৃষ্ণাও কাজ করে না। আমার কেবল মনে হয়, এই মানুষটা আমার চেনা। বহু দিনের চেনা।

পরদিন ভোরে পাগলপ্রায় আম্মা এসে হাজির। তিনি কিভাবে খবর পেয়েছেন কে জানে! আমাকে জড়িয়ে ধরে উথাল পাথাল কান্না। সিঁথিতে সিঁদুর আঁকা সেই ‘নোমো’ মহিলাটিকে ধরেও। তাকে বুকের সাথে চেপে ধরে আম্মা কাঁদেন! সেই কান্নায় ধুয়ে মুছে যায় এতো এতো বছর, এতো এতো দিন, এতো এতো মুহূর্ত ধরে গড়ে তোলা বিভেদের দেয়াল! হিন্দু আর মুসলমান! মিলেমিশে এক হয়ে যায় অদ্ভুত ভালোবাসায়, বিশ্বাসে, অনুভূতিতে, কান্নায়! আমি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখি। আমার হাতে তখন লাল-নীল-হলুদ রঙের চরকি, লম্বা বাঁশি, প্ল্যাস্টিকের চশমা, হাতের ভেতর পলিথিনে মোড়া নারকেলের নাড়ু, ধবধবে সাদা বাতাসা।

ওই সিঁদুর পড়া মহিলাটা আমাকে কিনে দিয়েছেন। আমি হঠাৎ আমার মায়ের সাথে আর ওই সিঁদুর পড়া মানুষটার সাথে আর কোন তফাৎ খুঁজে পাই না। লাল পিঁপড়া আর কালো পিপড়াতেও না। লাল শাপলা আর সাদা শাপলাতেও না, জল আর পানিতেও না। আমি কোন তফাৎ খুঁজে পাই না।

তফাৎ খুঁজে পাই না এই মানুষ দুজনের মধ্যেও। সেই সিঁদুর পড়া হিন্দু মমতাময়ী নারী আর আমার মায়ের ভেতর আলাদা করে কিছু খুঁজে পাই না আমি! কিচ্ছু না! শুধু খুঁজে পাই দুজন মানুষ! দুজন নারী।
দুজন মমতাময়ী মা।

সাদাত হোসাইন

সৌ: সঞ্জীব চক্রবর্তী।(ভায়া ফেসবুক)

Leave a comment