রবীন্দ্রনাথ ও রানু

প্রেমের গতি বিচিত্র। প্রেম বয়স, জাত-পাত, স্থান, কাল, পাত্র, ধর্ম্ম কিছু মানে না। দুটি হৃদয় কোন কিছু বিচার না করে কখন একে অন্যের নিকটে এসে যায় আমরা বুঝতে পারিনা । যখন বুঝতে পারি তখন দুজনের মধ্যে একটা ভালোলাগা বা প্রীতির সম্পর্কের জন্ম নেয় এবং এই সম্পর্ক প্রেমে পরিনত হয়। দুটি হৃদয়ের কি রসায়নে এটা ঘটে তা  দুর্ভেদ্য। কিন্তু অনেকের জ়ীবনেই , অনেকসময় এটা  ঘটে থাকে। এটা স্বাভাবিক।

“তরুন” হৃদয়বান পুরুষদের, বয়স যাই হোক না কেন, হৃদয়ে প্রেম জাগতে বাধা নেই।  অন্যদিকে প্রেমিকার বয়স কোনদিন পুরুষের প্রেম নিবেদনে  বাধা হয়নি।  তাইতো দেখা যায় – পঞ্চাসৌর্দ্ধ পুরুষ ,কন্যার সমবয়সী নারীর সাথে , এমনকি নাৎনীর বয়সী কিশোরীর সাথেও প্রেমের জালে জড়িয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ তাই লিখেছেন –

” প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে।
কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে —“

রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের জ়ীবনের উপলব্ধি থেকেই হয়ত একথা লিখেছেন কারন রবীন্দ্রনাথ একাধিকবার  প্রেমে পড়েছেন । সেই দিক থেকে তাঁর কিশোরী রাণুর প্রেমে পড়াটা একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা । এটাই  এখানে তুলে ধরতে চাই।

রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ  অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য মহাশয়  এই  অসমবয়সী সম্পর্কের উপর সম্প্রতি  তিনি তাঁর একটি লেখায়  আলোকপাত করেছেন । আমি কোনরকম অতিরঞ্জিত বা পরিবর্তিত না করে তাঁর লেখা থেকে  বিষয়টি নিম্নে উদ্ধৃত করলাম।

“অসমবয়সী রানু ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এক আশ্চর্য অন্তরঙ্গ নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ১৯১৭ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত। শিল্পপতির পুত্র বীরেন্দ্রের সঙ্গে বিবাহ স্থির হয়ে গেলে রানু-রবীন্দ্রের দীর্ঘ আট বছরের প্রীতি- ভালবাসার মধুর পরিণত সম্পর্কটি ছিন্ন হয়ে যায়। এই সময় সুন্দরী রানুর বয়স উনীশ। ১৯১৭-তে পরস্পরের পত্রবিনিময়ের মাধ্যমে যখন দুজনের অনির্বচনীয় একটি  সম্পর্কের ভিত্তিভূমি রচিত হচ্ছিল তখন রানুর বয়স এগারো, আর সেই সময়  নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রবীন্দ্রনাথের বয়স ছাপ্পান্ন। চিঠির পর চিঠিতে  ‘ভারী দুষ্টু’ রবীন্দ্রনাথকে চুম্বনের পর চুম্বন দিতে দিতে ‘প্রিয় রবিবাবু’ কে রানু বলে, “কেও জিজ্ঞাসা করলে বলবেন আপনার বয়স ‘সাতাশ’।” উত্তরে রবীন্দ্রনাথ কৌতুক করে বলেন , “আমার ভয় হয় পাছে লোকে সাতাশ শুনতে সাতাশি শুনে বসে। …….তুমি যদি রাজি থাক তাহলে আমি আর একটা বছর কমিয়ে বলতে পারি। কেন না ছাব্বিশ বললে ওর থেকে আর ভুল করবার ভাবনা থাকবে না।”

পঞ্জিকার হিসাবে তাঁর বয়স পঞ্চান্ন ষাট বাষট্টি  যাই হক, যৌবনের অধিকার বয়ষের মাপকাঠিতে বিচার্য নয়। তাঁর বাষট্টি বছর বয়সেও দেহসৌষ্ঠবে ও গঠনে তিনি ছিলেন অতুলনীয় রূপবান। এডওয়ার্ড  টমসনকে কবি নিজেই সেই সময় বলছেন, ‘আমি সেদিন পর্যন্ত ষাট বৎসরের পূর্ণ যৌবন  ভোগ করছিলুম’।

শিলং পাহাড়ের পথে যে রবীন্দ্রনাথকে  দিনের পর দিন সপ্তদশী রাণুর সঙ্গে সহাস্যে ভ্রমনরত দেখা গিয়েছে কিম্বা কলকাতার রঙ্গমঞ্চে “বিসর্জন” অভিনয়ে অপর্নারূপী রাণুর বিপরীতে জয়সিং’হের ভূমিকায় যে রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া গেল, পঞ্জিকার হিসেবে বাষট্টি হলেও যৌবনের দীপ্তিতে তাঁকে ছাব্বিশ-ই মনে  হয়েছিল সেদিন সকলের।  রাণু যে এই চিরযুবা রবীরন্দ্রনাথের শুধু ভ্রমনসঙ্গীই হয়েছিলেন তা নয়; কবির একান্ত মনের সঙ্গীতরূপেও ছিলেন দীর্ঘ আট বছর। রাণুর যৌবনের শ্রেষ্ঠ বসন্তের দিনগুলি শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে তাঁকে ভালবেসেই কেটে গিয়েছিল। উভয়ের প্রতি উভয়ের ভালবাসায় কোন অস্পষ্টতা ছিল না। কিন্তু এই সম্পর্ক উভয়ের মধ্যে  কতটা নৈকট্য এনে দেয় তা বলা কঠিন। অষ্টাদশী রাণুকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন : ” বিধাতা আমাকে অনেকটা পরিমানে একলা করে দিয়েছেন। কিন্তু তুমি হটাৎ এসে আমার সেই  জীবনের জটিলতার একান্তে যে বাসাটি বেঁধেছ, তাতে আমাকে আনন্দ দিয়েছে। হয়তো আমার কর্মে আমার সাধনায় এই জিনিসটির বিশেষ প্রয়োজন ছিল, তাই আমার বিধাতা এই রসটুকু আমাকে জুটিয়ে দিয়েছেন। “

রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর কর্মের প্রেরনা ষোড়শী সপ্তদশী অষ্টাদশীর কাছ থেকে দিনের পর দিন বছরের পর বছর পেয়েছেন; কিন্তু সেই নারীর কি তার যৌবনের একমাত্র পুরুষ ‘সাতাশ’ বয়সী কবির কাছ থেকে পাওয়ার মতো কোনও আকাঙ্ক্ষাই নেই? কবির দিক থেকেও কখনওই কি প্রকৃতির আহ্বান সংকল্পকে লংঘিত করতে পারে না ?  অষ্টাদশী রাণু রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করেছে-“আমি আপনার কে?” নিজেই বলেছে , “আমি আপনার বন্ধুও নই।” তবে কে? রাণুর উত্তর – ” আর কেউ জানবেও না।” এই চিঠিতেই রাণু মনের কপাট খুলে লিখে ফেলেছে – “আমি কাউকেই বিয়ে করব না – আপনার সঙ্গে ত বিয়ে হয়ে গেছে।…..আমার সমস্ত শরীর ছেয়ে সে আদর আমার মনকে ভরে দিয়েছিল।……. সেই SECRETটুকুতে ত কারুর অধিকার নেই।”  শেষপর্যন্ত রাণু বিবাহে সন্মত হয় ও এই চিঠির সাত মাস পরে রাণু-বীরেন্দ্রের বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহের ক’দিন পুর্বে রাণুকে ১৫৯ সংখ্যক পত্রে রবীন্দ্রনাথ “তুমি” স্থলে “তুই” সম্বোধন করে উভয়ের সম্পর্কের পূর্ব রেশটুকু ছিন্ন করে ফেলতে চাইলেন। বাহ্যত ছিন্ন করতে চাইলেও রবীন্দ্রনাথ কল্পনায় হয়ত ভেবেছিলেন বীরেন্দ্রের স্ত্রীর মনের আকাশে রবির আলোটুকু বুঝি উজ্জ্বল হয়েই থাকবে। ১৯২৩-এ রাণু ছিলেন, ১৯২৭-এ রাণুবিহীন শিলং কবির ভালো লাগলো না- “এ আর এক শিলং”।

লেখক লিখছেন –  ১৯২৮ এ  দক্ষিনভারতে বসে কবি লিখতে শুরু করলেন শিলং পাহাড়ের পটভুমিতে অমিত-লাবন্যর প্রনয়োপন্যাস “শেষের কবিতা “। ………. ‘শেষের কবিতা’ রচনার বছর তিনেক  পুর্বেই কবির জীবনমঞ্চে অভিনীত হয়ে গিয়েছিল শেষের কবিতার পালা – যার নায়িকা “শ্রীমতি রাণু সুন্দরী দেবী” এবং যার নায়ক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
বিবাহোত্তর জীবনে রাণু  “লেডি রাণু মুখার্জ্জী” নামে খ্যাত।

 ঋনস্বীকার : – “রবীন্দ্রনাথ রাণু ও শেষের কবিতা ” By অমিত্রসূধন ভট্টাচার্য Published in  Times of India (আমার সময়)  dated 11 Sep 2010