Tagore
রবীন্দ্রনাথ ও রানু
“তরুন” হৃদয়বান পুরুষদের, বয়স যাই হোক না কেন, হৃদয়ে প্রেম জাগতে বাধা নেই। অন্যদিকে প্রেমিকার বয়স কোনদিন পুরুষের প্রেম নিবেদনে বাধা হয়নি। তাইতো দেখা যায় – পঞ্চাসৌর্দ্ধ পুরুষ ,কন্যার সমবয়সী নারীর সাথে , এমনকি নাৎনীর বয়সী কিশোরীর সাথেও প্রেমের জালে জড়িয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ তাই লিখেছেন –
রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য মহাশয় এই অসমবয়সী সম্পর্কের উপর সম্প্রতি তিনি তাঁর একটি লেখায় আলোকপাত করেছেন । আমি কোনরকম অতিরঞ্জিত বা পরিবর্তিত না করে তাঁর লেখা থেকে বিষয়টি নিম্নে উদ্ধৃত করলাম।
“অসমবয়সী রানু ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এক আশ্চর্য অন্তরঙ্গ নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ১৯১৭ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত। শিল্পপতির পুত্র বীরেন্দ্রের সঙ্গে বিবাহ স্থির হয়ে গেলে রানু-রবীন্দ্রের দীর্ঘ আট বছরের প্রীতি- ভালবাসার মধুর পরিণত সম্পর্কটি ছিন্ন হয়ে যায়। এই সময় সুন্দরী রানুর বয়স উনীশ। ১৯১৭-তে পরস্পরের পত্রবিনিময়ের মাধ্যমে যখন দুজনের অনির্বচনীয় একটি সম্পর্কের ভিত্তিভূমি রচিত হচ্ছিল তখন রানুর বয়স এগারো, আর সেই সময় নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রবীন্দ্রনাথের বয়স ছাপ্পান্ন। চিঠির পর চিঠিতে ‘ভারী দুষ্টু’ রবীন্দ্রনাথকে চুম্বনের পর চুম্বন দিতে দিতে ‘প্রিয় রবিবাবু’ কে রানু বলে, “কেও জিজ্ঞাসা করলে বলবেন আপনার বয়স ‘সাতাশ’।” উত্তরে রবীন্দ্রনাথ কৌতুক করে বলেন , “আমার ভয় হয় পাছে লোকে সাতাশ শুনতে সাতাশি শুনে বসে। …….তুমি যদি রাজি থাক তাহলে আমি আর একটা বছর কমিয়ে বলতে পারি। কেন না ছাব্বিশ বললে ওর থেকে আর ভুল করবার ভাবনা থাকবে না।”
পঞ্জিকার হিসাবে তাঁর বয়স পঞ্চান্ন ষাট বাষট্টি যাই হক, যৌবনের অধিকার বয়ষের মাপকাঠিতে বিচার্য নয়। তাঁর বাষট্টি বছর বয়সেও দেহসৌষ্ঠবে ও গঠনে তিনি ছিলেন অতুলনীয় রূপবান। এডওয়ার্ড টমসনকে কবি নিজেই সেই সময় বলছেন, ‘আমি সেদিন পর্যন্ত ষাট বৎসরের পূর্ণ যৌবন ভোগ করছিলুম’।
শিলং পাহাড়ের পথে যে রবীন্দ্রনাথকে দিনের পর দিন সপ্তদশী রাণুর সঙ্গে সহাস্যে ভ্রমনরত দেখা গিয়েছে কিম্বা কলকাতার রঙ্গমঞ্চে “বিসর্জন” অভিনয়ে অপর্নারূপী রাণুর বিপরীতে জয়সিং’হের ভূমিকায় যে রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া গেল, পঞ্জিকার হিসেবে বাষট্টি হলেও যৌবনের দীপ্তিতে তাঁকে ছাব্বিশ-ই মনে হয়েছিল সেদিন সকলের। রাণু যে এই চিরযুবা রবীরন্দ্রনাথের শুধু ভ্রমনসঙ্গীই হয়েছিলেন তা নয়; কবির একান্ত মনের সঙ্গীতরূপেও ছিলেন দীর্ঘ আট বছর। রাণুর যৌবনের শ্রেষ্ঠ বসন্তের দিনগুলি শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে তাঁকে ভালবেসেই কেটে গিয়েছিল। উভয়ের প্রতি উভয়ের ভালবাসায় কোন অস্পষ্টতা ছিল না। কিন্তু এই সম্পর্ক উভয়ের মধ্যে কতটা নৈকট্য এনে দেয় তা বলা কঠিন। অষ্টাদশী রাণুকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন : ” বিধাতা আমাকে অনেকটা পরিমানে একলা করে দিয়েছেন। কিন্তু তুমি হটাৎ এসে আমার সেই জীবনের জটিলতার একান্তে যে বাসাটি বেঁধেছ, তাতে আমাকে আনন্দ দিয়েছে। হয়তো আমার কর্মে আমার সাধনায় এই জিনিসটির বিশেষ প্রয়োজন ছিল, তাই আমার বিধাতা এই রসটুকু আমাকে জুটিয়ে দিয়েছেন। “
রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর কর্মের প্রেরনা ষোড়শী সপ্তদশী অষ্টাদশীর কাছ থেকে দিনের পর দিন বছরের পর বছর পেয়েছেন; কিন্তু সেই নারীর কি তার যৌবনের একমাত্র পুরুষ ‘সাতাশ’ বয়সী কবির কাছ থেকে পাওয়ার মতো কোনও আকাঙ্ক্ষাই নেই? কবির দিক থেকেও কখনওই কি প্রকৃতির আহ্বান সংকল্পকে লংঘিত করতে পারে না ? অষ্টাদশী রাণু রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করেছে-“আমি আপনার কে?” নিজেই বলেছে , “আমি আপনার বন্ধুও নই।” তবে কে? রাণুর উত্তর – ” আর কেউ জানবেও না।” এই চিঠিতেই রাণু মনের কপাট খুলে লিখে ফেলেছে – “আমি কাউকেই বিয়ে করব না – আপনার সঙ্গে ত বিয়ে হয়ে গেছে।…..আমার সমস্ত শরীর ছেয়ে সে আদর আমার মনকে ভরে দিয়েছিল।……. সেই SECRETটুকুতে ত কারুর অধিকার নেই।” শেষপর্যন্ত রাণু বিবাহে সন্মত হয় ও এই চিঠির সাত মাস পরে রাণু-বীরেন্দ্রের বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহের ক’দিন পুর্বে রাণুকে ১৫৯ সংখ্যক পত্রে রবীন্দ্রনাথ “তুমি” স্থলে “তুই” সম্বোধন করে উভয়ের সম্পর্কের পূর্ব রেশটুকু ছিন্ন করে ফেলতে চাইলেন। বাহ্যত ছিন্ন করতে চাইলেও রবীন্দ্রনাথ কল্পনায় হয়ত ভেবেছিলেন বীরেন্দ্রের স্ত্রীর মনের আকাশে রবির আলোটুকু বুঝি উজ্জ্বল হয়েই থাকবে। ১৯২৩-এ রাণু ছিলেন, ১৯২৭-এ রাণুবিহীন শিলং কবির ভালো লাগলো না- “এ আর এক শিলং”।
লেখক লিখছেন – ১৯২৮ এ দক্ষিনভারতে বসে কবি লিখতে শুরু করলেন শিলং পাহাড়ের পটভুমিতে অমিত-লাবন্যর প্রনয়োপন্যাস “শেষের কবিতা “। ………. ‘শেষের কবিতা’ রচনার বছর তিনেক পুর্বেই কবির জীবনমঞ্চে অভিনীত হয়ে গিয়েছিল শেষের কবিতার পালা – যার নায়িকা “শ্রীমতি রাণু সুন্দরী দেবী” এবং যার নায়ক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
বিবাহোত্তর জীবনে রাণু “লেডি রাণু মুখার্জ্জী” নামে খ্যাত।
ঋনস্বীকার : – “রবীন্দ্রনাথ রাণু ও শেষের কবিতা ” By অমিত্রসূধন ভট্টাচার্য Published in Times of India (আমার সময়) dated 11 Sep 2010
সার্ধশতবর্ষে বিশ্বকবি
- রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাবামায়ের চতুর্দশ (14th) সন্তান। এর পরেও আর একটি সন্তান হয়েছিল (বুধেন্দ্রনাথ) কিন্তু বেশীদিন বাঁচেনি। তাই রবীন্দ্রনাথ কনীষ্ঠতম সন্তান বললে ভুল হবে।
- রবীন্দ্রনাথের কৌলিকপদবি বন্দ্যোপাধ্যায় ছিল। শান্ডিল্য-গোত্রীয় ভট্টনারায়ন থেকে ঠাকুর পরিবারের উদ্ভব। একি বছরে (1861)জন্মেছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র সরকার ও কিম্বদন্তী চিকিৎসক ডঃ নীলরতন সরকার।
- ভাগ্নের কাছে কাব্যে হাতেখড়ি। শ্লেটে লেখা সে কবিতা আর নেই। পরবর্তী সময়ে শিক্ষক সাতকড়ি দত্ত দু লাইন লিখে প্রিয় ছাত্রকে পাদ পুরন করতে বললেন। মাষ্টার লিখলেন –
আমাদের কবির পাদপুরন —

বিড়ম্বনা – ১১ আগষ্ট ১৯১০ গীতাঞ্জলির পান্ডুলিপি প্রেসে যায় এবং প্রকাশ ৫ সেপ্টেম্বর । এক সপ্তাহ পরে কবি তাঁর পরিচিত এক পত্রিকা সহসম্পাদককে অনুরোধ করেছেন, তাঁর দ্বিতীয় বিবাহের গুজবের প্রতিবাদ করতে।
কিছুদিন পরে কবিকে সংবর্ধনা দেবার প্রস্তাবে এমনই দলাদলি যে অপমানিত কবি লিখেছেন – “আমাদের দেশে জন্মলাভকে একটা পরম দুঃখ বলিয়া থাকে, কথাতা যে অমুলক নহে তাহা আমার জন্মদিনে….. বিশেষভাবে অনুভাব করিবার কারন ঘটিল।
অনুবাদে প্রারম্ভিক ব্যর্থতা – ইংরেজি অনুবাদের চেষ্টা নানাভাবে হয়েছিল। প্রথম অনুবাদকদের মধ্যে রয়েছেন স্যার যদুনাথ সরকার। জগদীশচন্দ্রের সহায়তায় নিবেদিতা তিন্তি গল্প অনুবাদ করে ইংল্যান্ডের পত্রিকায় পাঠান, কিন্তু রিজেক্ট হয়, পান্ডুলিপিও হারিয়ে যায়।
হারানো প্রাপ্তি – বিলেত যাবার পথে জাহাজে রবীন্দ্রনাথ নিজে গীতাঞ্জলীর যে ইংরেজি অনুবাদ করেন সেই খাতাটিও পুত্র রথীন্দ্রনাথ লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনে ফেলে আসেন, অথচ পরের দিন সবেধন নীলমনি এই পান্ডুলিপিটি কবি রোটেনস্টাইনকে দেবেন। বিপর্যস্ত রথীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের পরম দয়ায় পরের দিন – LOST & FOUND অফিসে খাতাটি পান, না হলে ভাগ্যের ধারা অন্যদিকে প্রবাহিত হত।
স্মরনীয় রবীন্দ্রনাথ – সার্ধশতবর্ষে বিড়ম্বিত এই রবীন্দ্রনাথকে আমাদের স্মরন করা প্রয়োজন, তা না করলে আরও দেড়শ বছর পর তাঁর সৃষ্টির আমৃতসাগরে অবগাহন করেও মনে হতে পারে রবীন্দ্রনাথ বলে কোনও মানুষ এই পৃথিবীতে ৮১ বছর বসবাস করেননি, স্বর্গলোক থেকে কোনও অদৃশ্য শক্তি তাঁর অমৃতবানীগুলিকে মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছিল।