ফিরে দেখা

চারতলার ছাদ জুড়ে ম্যারাপ, তার এক দিকে চটের পর্দার আড়ালে ঠাকুররা রান্না করছে সকাল থেকে। ইঁট আর গোবর মাটি দিয়ে বানানো হয়েছে দুটো বড়ো উনুন। কয়লার গনগনে আঁচে দুটো প্রমান সাইজের কড়া। সাত সকালেই জলখাবারে হয়ে গেছে লুচি, আলুর তরকারী আর সঙ্গে বোঁদে। অবশিষ্ট কিছু লুচি কাগজ চাপা দিয়ে ঝুড়িতে রাখা, তার পাশে একটা গামলায় কিছু বেঁচে যাওয়া আলুর তরকারি। কুমড়োর ছক্কা, ছোলার ডাল রান্না হয়ে গেছে। এবার হবে সকালের মাছ রান্না। এক কোণে বসে মশলা বাটছে একজন, একজন ঘন ঘন চোখ মুছে কেটে চলেছে পেঁয়াজ আর কম বয়সী একটা ছেলে ছাড়াচ্ছে রসুন। হামানদিস্তেতে মশলা গুঁড়িয়ে চলেছে ষন্ডা মার্কা একটা লোক। বড়ো বড়ো কাতলা মাছের টুকরো বিশাল নৌকোয় একতলায় কলের জলে ধুয়ে তাতে নুন হলুদ মাখাচ্ছে ঠাকুর। কড়ায় তেল গরম হচ্ছে, মাছ ভাজা হবে। অন্যদিকে ফিশ ফ্রাই গড়া শেষ, বিস্কুটের গুঁড়োয় মাখামাখি হয়ে বারকোষে সেজেগুজে বসে আছে তারা। ডেকচিতে কাগজ চাপা দেওয়া ভাত, পাশে বড়ো গামলিতে মুগের ডাল আর ট্রেতে বেগুন ভাজা। দুটো নৌকো বোঝাই কাঁচা মাংস এক পাশে রাখা। পুঁইশাক, কুমড়ো, মূলো, আলু ডাই করে কুটে রাখা আর একটা বারকোষে, ছেঁচড়া হবে মাছের মাথা দিয়ে। বিয়ে বাড়ির সকালের অবশ্য পদ।

ছাদের অন্যদিকে কাঠের ফোল্ডিং চেয়ারগুলো এক কোণে হেলান দিয়ে রাখা, তার পাশে সার সার উঁচু করে রাখা লম্বা কাঠের টেবিল। সন্ধ্যে হতে না হতেই টেবিল পাতা হয়ে গেলো, সঙ্গে চেয়ার। এক একটা টেবিলে পাঁচজন করে বসার ব্যবস্থা। কাগজের রোল টেবিলে জল ছিটিয়ে বিছানো শেষ, তার ওপর দুপুরে ধোয়া লম্বাটে কলাপাতায় মাটির গেলাস উপুড় করা, তার পাশে উপুড় করে রাখা ছোটো খুড়ি। ব্যাচ শুরু হওয়ার আগেই গেলাস আর খুড়ি সরিয়ে ডানদিকের এক কোণে নুন আর এক চিলতে লেবু দেওয়া হলো। এই কাজটা ছোটদের জন্যে বরাদ্দ। নুন লেবুর পাশেই সেদ্ধ ছোলা/কড়াইশুঁটি, পোস্ত ছড়ানো এক চামচ হিমশীতল শাক ভাজা আর তেলে মাখামাখি সরু একফালি ন্যাতানো বেগুন ভাজা। চটের পর্দার গেটের মুখে বিয়েবাড়ি স্পেশালিস্ট মামা/কাকা/পিসে বা মেসো গোছের কেউ দাঁড়িয়ে তদারকি শুরু করেছেন। লোকজন বসতে না বসতেই ব্যাচ শুরু। সব গেলাসে জল দেওয়ার সাথে সাথে চতুর্দিক থেকে ‘গেলো গেলো’ রব। ফুটো গেলাস দিয়ে জল গড়িয়ে গায়ের দিকে এগিয়ে আসছে। কেউ উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে, কেউ আবার তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে চেয়ার উল্টেছে। কোমরে গামছা বাঁধা গেঞ্জি গায়ে পরিবেশনকারী আধা ঠান্ডা দুটো করে লুচি ঝপাঝপ পাতে দিয়ে গেলো, তার কোনোটা গোল আবার কোনোটা অর্ধেক মোড়া। ট্রে হাতে আর একজন হাতায় করে কুমড়োর ছক্কা দিয়ে যাচ্ছে। এবার গরম লুচি রিপিট, সংগে একজন ছোলার ডালের বালতি নিয়ে হাতায় তুলে পাতে ঢেলে দিলো। গরমাগরম ফ্রাই এলো তারপর, তার পেছন পেছন একজন কাসুন্দির বাটি হাতে। তার মাঝেই চলছে ঘুরে ঘুরে পরিবেশনকারীদের ডজ করে পাশ কাটিয়ে, আমন্ত্রনকারী মেয়ে পুরুষের হাসি মুখে অতিথি আপ্যায়ন। আর তারই ফাঁকে ট্রে থেকে পটাপট ফ্রাই তুলে মুখে চালানও করে দিচ্ছে কেউ কেউ। এক দুরন্ত বাচ্চা খেতে খেতে দোল খাবার ইচ্ছে প্রকাশ করে চেয়ার সমেত মাটিতে চিৎপটাং। পাশে বসা তার বাবা স্থানকাল ভুলে তাকে কান ধরে টেনে তুললেন। মাছের সংগে কারি পাতে পড়তেই সকলে সাবধান, কলাপাতার গা বেয়ে কোঁচানো ধুতি তার গন্তব্যস্থল। কিছু সেয়ানা লোক কলাপাতার তলায় লুচির টুকরো গুঁজে উঁচু করে ঝোলের আক্রমণ থেকে বাঁচবার চেষ্টায়। এরপর বালতিতে ডুব সাঁতার দিতে দিতে কচি পাঁঠার আগমন, সংগে দলা পাকানো হলুদ রঙের মিষ্টি পোলাও (ফ্রায়েড রাইসের প্রচলন তখনো ততটা হয়নি)। প্রায় সংগে সংগেই কাদার মতো এক থাবা টমেটোর চাটনি, সংগে তেল গড়ানো এক ফালি পাঁপড় ভাজা পড়লো পাতে। পাত তো নয়, দেখে মনে হয় ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে পাতের ওপর দিয়ে। সেটা শেষ হতে না হতেই, না ধোয়া খুড়িতে এক খাবলা দই। দইয়ে হাত দেওয়ার আগেই দরবেশ আর লেডিগেনির আগমন, যেন যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু আক্রমণ শানাচ্ছে মুহুর্মুহু। লেডিগেনির রস, মাংসের ঝোল আর চাটনীর মিশ্রনে অম্ল মধুর এক বিচিত্র স্বাদ দরবেশের। পেল্লাই সাইজের রসগোল্লা পাতে পড়ার সাথে সাথে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো লবঙ্গ গাঁথা পান। মানে, উঠে পড়ো বাছাধন, পরের ব্যাচ বসবে এবার। সিঁড়ির মুখে “ঠিক করে খেয়েছেন তো?” বলে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে নিমন্ত্রণকারীর কেউ না কেউ। …………..

এটাই আমাদের ছোটবেলা। এখন কাঁচের ভারী প্লেট নিয়ে লাইনে গিয়ে দাঁড়াই। নিজেকে কেমন যেন কয়েদি কয়েদি মনে হয়, পকেটে কয়েদি নম্বরটাই যা শুধু লেখা নেই। ঝলমলে আলোর নিচে রকমারি দেশি বিদেশি পদ পিতলের পাত্রে স্পিরিট ল্যাম্পের ওপর। প্রতিটি পদের সামনে দন্ডায়মান সীমান্তরক্ষীর মতো এক এক জন। রোবটের মতো হাত ওঠানামা করছে কঠিন মুখে। নিঃসন্দেহে স্বাদে গন্ধে ভালো প্রতিটি পদ, তবু বোকা অবুঝ মন আমার খুঁজে বেড়ায় কলাপাতার কোণে ঠান্ডা এক চামচ শাক আর ন্যাতানো বেগুনভাজাকে আর চোখ খুঁজে মরে স্যান্ডো গেঞ্জি পড়া এক ঝাঁক তরতাজা হাসিমুখ তরুণকে, যারা লোক বুঝে হাত চেপে পাতে ফেলে দেবে আরও দুটো রসগোল্লা। সাদা জামাপ্যান্ট পরা এক শিশু মোবাইল হাতে চেয়ারে বসে পা দুলিয়ে গেম খেলছে এক মনে। সাবধান করতে গিয়ে নিজের মনেই হেসে উঠি, এ চেয়ার ফোল্ডিং কাঠের চেয়ারের মতো দোলালেও উল্টোয় না। আমন্ত্রণকারীরা সবাই ব্যস্ত। ধীর পায়ে বেরিয়ে আসি অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে, হাসি মুখে কেউ জিজ্ঞেস করার নেই, “ঠিক করে খেয়েছেন তো?”

সংগৃহীত