আমার ক্লাসে দুটি মেয়ে ছিল। পাশের গ্রাম থেকে তারা একসাথে আসতো। একটি মেয়ে যার নাম ছিল কৃষ্ণা অধিকারি তাদের বাড়িতে RADIO ছিল এবং সে নিয়মিত গান শুনতো। একদিন ক্লাসে টিচার তাকে একটা গান গাইতে বলায়, সে তখন শচিন দেব বর্মনের ” ঝিলমিল ঝিলমিল ঝাউয়ের বনে ঢেউ খেলিয়া যায়..” গানটি গেয়েছিল। সেদিনই আমি প্রথম এই গানটা এবং শচিন দেবের নাম শুনলাম। কৃষ্ণা গ্রামের মেয়ে হলেও সে ছিল সপ্রতিভ , বুদ্ধিমতি ও দেখতে ভালই । গজদন্তী ছিল, হাসলে দেখতে আরো ভাল লাগত। তখন সবার বাড়ীতে RADIO থাকতো না। ওর বাড়ীতে সেটা ছিল। তাই বুঝতে আসুবিধা হয় না যে সে সচ্ছল পরিবারের মেয়ে ছিল।
সে এক গ্রাম থেকে হেঁটে আসতো। আমিও প্রায় ১০ কি,মি, হেঁটে স্কুলে যেতাম। তবে অন্য গ্রাম থেকে। মাঠ পেরিয়ে, পুকুরের পাড় ধরে, ক্ষেতের আল ধরে, দহ ও জঙ্গল পেরিয়ে স্কুলে যেতাম। আজকের দিনে এসব কেও বিশ্বাস করবে না। আজ ভেবে আমি নিজেই অবাক হই। সে যাই হোক, তখন সব গ্রামে স্কুল থাকতো না তাই আমরা তখন সেটাই স্বাভাবিক মনে হত। যা বলছিলাম। কৃষ্ণা ছিল সাধারন মেয়ে কিন্তু আবার অসাধারনও। মেয়েরা তাড়াতাড়ি Matured হয়, এখন জানি, তখন জানতাম না। সেই বয়সে আমরা ছেলেরা বোকা বোকাই থেকে যাই।সে সময় আমাদের বঃয়সন্ধির বয়স। প্রেম ভালবাসার কিছুই জানতাম না। মনে তখন বীপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষনও জন্মায়নি। ক্লাস বন্ধুর বেশী কিছু জানতাম না।
ক্লাস সেভেন বার্ষিক পরীক্ষার আগে একদিন গাছের নীচে বসে লাইব্রেরীর একটা বই পড়ছিলাম। সে এগিয়ে কাছে এসে বলল ” কি পড়ছ এত মন দিয়ে?” বইটা দেখালাম। তারপর বলল – তুমি চিত্তরঞ্জনে Admission নেবে ? আমি বললাম- “হয়তো”। আমি জিজ্ঞেস করলাম -” আর তুমি”? সে বলল – “জানি না, হয়তো এখানেই শেষ। কাছাকাছি তো কোন হাই স্কুল নেই। ” আমার কিছু বলার ছিল না। নীরবতা ভেঙ্গে সে এবার হাসতে হাসতে বলল ” যাও চিত্তরঞ্জনে গিয়ে , তোমার চিত্ত রঞ্জন কর”। বলে গজদন্ত বের করে হাসলো। সে এত সুন্দর কথা বলতে পারে জানা ছিল না। আমার মুখে কোন কথা এল না তক্ষণ। একটু হেসেছিলাম। এখন হলে বলতাম – চিত্ত রঞ্জন করার জন্য চিত্তরঞ্জন যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। এখানে এই গাছের ছায়াতেও মনকে রঞ্জিত করতে পারি। কিন্তু সেদিন কিছু বলতে পারিনি। কথাটা বলে সে হাসতে হাসতে চলে গেল। আমি কিছুক্ষন চুপচাপ বসে রইলাম। “চিত্ত” আর “রঞ্জন” কথাদুটো মনে মনে আওড়ালাম দুবার। সে হয়ত প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল। বুঝতে বাকি রইল না যে সে আমার থেকে কথায় অনেক পটু এবং বয়স সমান হলেও সে এগিয়ে আছে।
ক্লাস সেভেন (Middle school) পাশ করে গ্রামের স্কুল ছেড়ে ছোটো এক শিল্পনগরীতে এলাম। তারপর আর কারো সাথে যোগাযোগ রইলো না । তার পড়াশোনার কি হল জানা নেই। হয়ত পড়াশোনা আর হয় নি। কয়েক বছর পর হয়ত শশুর বাড়ী গিয়ে সংসার ধর্ম পালনে বাধ্য হয়েছে । তাছাড়া করার আছেই বা কি। সুযোগ পেলে সেও আজ আমার সমকক্ষ বা বেশী শিক্ষিত হতে পারতো। সুযোগ না পাওয়াটা তার দোষের না। এই ভাবে ভারতবর্ষে বহু মেধাবি মেয়ে পড়াশোনা থেকে বঞ্ছিত হয় এবং চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। এটা তারই একটা উদাহরন মাত্র । সেও হারিয়ে গেছে, কিন্তু স্মৃতিতে তার ছবিটা রয়ে গেছে ওই সামান্য একটা কথার জন্য কারন ওর কথাটাই সত্য হয়েছিল। সে ভবিষ্যত দ্রষ্টার মত ভবিষ্যত বাণী করেছিল সেদিন।তাই তার সরলতা, তার বুদ্ধিদীপ্ত কথা স্মৃতিতে রয়ে গেছে। আজ সকালের ওই একটি গান সব কিছু মনে করিয়ে দিল। কিছু স্মৃতি কোনদিনই মোছে না, হৃদয়ের অন্তঃস্থলে থেকে যায় এবং মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে যায়।
স্মৃতি রোমন্থন দেখতে পেলাম কৌতুহলী হয়ে দেখতে এসে….
আমার ব্লগে “বাংলা স্ক্রিপ্ট ইন PC” জাতীয় লেখাটার লিঙ্ক এই ব্লগ থেকে গেছে দেখে দেখতে এসেছিলাম… অনেক ভালো লাগলো..
ছেলেবেলার মানুষগুলো কত দুরে হারিয়ে যায়, তাইনা ভাইয়া?
আমার ব্লগ কারো উপকারে এসেছে ভেবে খুশি লাগছে…. 🙂
LikeLike
মাহমুদ ভাই,
আমি আপনার সাইট থেকে ডাউনলোড করে বাংলায় লেখা শুরু করি। তারপর আপনাকে একটা মেইল করেছিলাম, আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে।
যাইহোক আপনার মন্তব্য দেখে খুব খুশি হলাম। ভাল লাগলো।
ভাল থাকুন। আবার দেখা হবে।
LikeLike