Rajeswari Dutta রাজেশ্বরী দত্ত

জন্মসুত্রে পাঞ্জাব দুহিতা রাজেশ্বরী ঘন্টার পর ঘন্টা রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে ভালবাসতেন,রাগাশ্রয়ী ও টপ্পা গানে তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত,তবু সংগীতকে পেশা করেন নি। অর্জুনদাস বাসুদেব ছিলেন লাহোর হাইকোর্টের বিচারপতি। তাঁর মেধাবী কন্যা রাজেশ্বরীর লেখা পড়া লাহোরেই। শুধুমাত্র রবীন্দ্র সঙ্গীত শেখার তাগিদেই তিন মাসের মধ্যে শিখে ফেলেছিলেন বাংলা ভাষা। সে কালে মেয়েদের গান শেখার পরিবেশ সহজ ছিল না। স্নাতক হওয়ার পর মেধাবী রাজেশ্বরী এক রকম জোর করেই শান্তিনিকেতনে চলে আসেন সঙ্গীতশিক্ষার জন্য। সেটা ছিল ১৯৩৮ সাল। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত চার বছরের শিক্ষাক্রমে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখেন শান্তিদেব ঘোষ, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, ইন্দুলেখা ঘোষ, অমিতা সেন (খুকু) প্রমুখের কাছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে তালিমের সঙ্গে পেয়েছেন তাঁর স্নেহ,ভালবাসা, আশীর্বাদ । অবাঙালি কন্যাটির প্রতিভা ও সুকণ্ঠ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অগাধ আস্থা ছিল, অন্দরমহলে তিনি আক্ষেপ করতেন শারীরিক অসমর্থতার জন্য একে আমার শিখিয়ে যাওয়া হল না। তিনি রাজেশ্বরী বাসুদেব (দত্ত) এক ব্যতিক্রমী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়েও উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন, অথচ প্রায় অনালোচিত !

রাজেশ্বরী  চার বছর বয়সে গান গাওয়া শুরু করেছেন,প্রথম পাবলিক পাবলিক পারফরমেন্স করেন বেশ অল্প বয়সে, গেয়েছিলেন ক্যাসিক্যাল, ঠুংরী ও রাগঘেষা গান কোনও গুরুর কাছে না শিখেই।গ্ৰ্যাজুয়েট হওয়ার পরে শান্তিনিকেতনে গেলেন একটা স্কলারশিপ পেয়ে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর অপরূপ ভঙ্গীতে অবাঙালি রাশেশ্বরী বাসুদেব সন্মোহিত, গানের রসগ্ৰহনের দূর্বার আকর্ষণে শান্তিনিকেতনে যাওয়ার প্রথম তিন মাসে শিখে ফেলেছিলেন বাংলা ভাষা। অবশ্য মেধাবী রাজেশ্বরী ফরাসি, ইটালীয়, জার্মান ভাষা শিখে এই সব ভাষার কিছু কবিতা অনুবাদ করেছেন স্বামী সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে।

রাজেশ্বরীর জীবনে শান্তিনিকেতন পর্বেই ঘটেছে জীবনের এক বিশেষ ঘটনা। রাজেশ্বরীর ‘ফুল বলে ধন্য আমি’ শুনে কবি সুধীন্দ্রনাথ মোহিত। তবে তিনি বিবাহিত, কিন্তু কিছু দিন ধরেই বনিবনা হচ্ছে না প্রথমা স্ত্রীর সঙ্গে।একটা দূরত্বও তৈরি হয়েছে।  ঘনিয়ে উঠল রাজেশ্বরীর সঙ্গে প্রেম। দু’জনের মধ্যে বহু পত্রবিনিময় হয়। ওদিক সুধীন দত্তের স্ত্রী বর্তমান, উপরন্তু দু’জনের মধ্যে বয়সের ফারাক অনেকটা— এ সব নিয়ে অনেক টানাপড়েনের পর ১৯৪৩-এর ২৯ মে লাহোরে বিবাহ।

সেই ৪৩ থেকে ৬০ রাজেশ্বরীর জীবনে স্বপ্নরাঙা অধ্যায়। একদিকে সুধীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে কাব্য ও সমালোচনা কে ধ্রুপদীভাবের মর্যাদাভূষিত করছেন,অন্যদিকে রাগভিত্তিক রবীন্দ্রসঙ্গীতের দীপ্তিতে রাজেশ্বরী সঙ্গীত জীবন আলোকময়।স্বামী -স্ত্রী দুজন দুজনের প্রেরণা। রাজেশ্বরীর একের পর এক রেকর্ড বের হতে লাগল। ‘শেষ গানেরই রেশ ‘, ‘ওগো আমার চির -অচেনা’,  ‘যে রাতে মোর দুয়ারখাগুলি’, ‘আজি যে রজনী যায় ‘, সহ আরও অনেক। রাজেশ্বরী সম্ভবত একমাত্র শিল্পী যিনি একই দিনে বেতারে ভজন, ঠুংরী এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত সমান দক্ষতায় পরিবেশন করেছেন। নিজের মুখে অবশ্য  বলেছেন “ক্ল্যাসিক্যাল গানের প্রতি আমার ভালবাসা গভীর একথা সত্যি হলেও রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার মনের আকাশকে এমন এক বিচিত্র আবেগে রাঙিয়ে তুলেছিল যে এ গানের জন্য আমি আলাদা এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করতাম “।

১৯৬০সালে মাত্র ৫৯ বছরে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত চলে গেলেন লোকাত্তরে। তিনি যে শুধু রাজেশ্বরীর স্বামী ছিলেন না, ছিলেন পরম বান্ধব,দর্শনসখা,আত্মার প্রদীপ। এরপর রাজেশ্বরী বিদেশে চলে গেলেন, থেকে যান লন্ডনে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারারের পদ নিয়ে ভাষা ও লাইব্রেরী বিজ্ঞানের উপর থিসিস লেখেন। লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে ‘ স্কুল অফ আফ্রিকান অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে’ এর সংগীত বিভাগের ডাইরেক্টর হন। জন্মসুত্রে বাঙালি না হয়েও রাজেশ্বরী অনেক বাঙালির থেকে বেশি বাঙালি ছিলেন। সত্যিই সুধীন্দ্রনাথ ও রাজেশ্বরী দত্ত জুটি  কবিতা ও সংগীতের এক মিলনকাব্য। রাজেশ্বরী দত্ত সম্পর্কে সঙ্গীতের সমালোচকরা বলেন তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, চাইলে বড় ধ্রুপদী হতে পারতেন,খেয়ালিয়া হতে পারতেন, ভারতের শীর্ষ মানের গজল কিংবা ভজন গাইয়ে হতে পারতেন। কিন্তু উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বিরাট পটভূমি থাকা সত্ত্বেও তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত কে ভালবেসেছিলেন।গান তাঁর পেশা নয় ছিল ধর্ম। জামশেদপুরে রাজেশ্বরী দত্তের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দেবব্রত বিশ্বাস ফরাসি ভাষায় একটি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে শুনিয়েছিলেন। প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য, বৈদগ্ধা,প্রতিভার অধিকারী হয়েও রাজেশ্বরী ছিলেন স্নিগ্ধ,বিনয়ী,কোমল প্রসন্নভরা এক অসাধারণ চরিত্র।
সংকলনে ✍🏻 অরুণাভ সেন।।
সংগৃহীত

#RajeshwariDutta